Friday, July 4, 2014

এগারো বছরে রবি আত্মসাৎ করে তরঙ্গ ফির ১ হাজার কোটি টাকা

Posted by with No comments

এগারো বছরে রবি আত্মসাৎ করে তরঙ্গ ফির ১ হাজার কোটি টাকা

এগারো বছরে রবি আত্মসাৎ করে তরঙ্গ ফির ১ হাজার কোটি টাকা
ঢাকা, ১৭ জুন- মোবাইল ফোন অপারেটর রবির বিরুদ্ধে সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে ৬৪৭ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি আর অবৈধ ভিওআইপির নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের পরও সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন টেলিকম সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করার বিষয়টি রহস্যজনক। এত ভয়াবহ কেলেংকারির পরও রবির বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে না যাওয়া সরকারের দুর্বলতার বহির্প্রকাশ বলেও তারা মত প্রকাশ করেছেন। তাদের বক্তব্য, রবি হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েও উল্টো কথায় কথায় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়ার সাহসই বা পাচ্ছে কোথা থেকে? তাদের খুঁটির জোর কোথায়? প্রকাশ্যে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী প্রতিষ্ঠান রবির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন এখনও কেন মামলা করছে না? অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশী মালিকানার কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সামান্য টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি কিংবা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ নিয়ে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুদক যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে মালয়েশিয়াভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি রবি আজিয়াটার বিরুদ্ধে মনোভাব সম্পূর্ণ তার উল্টো। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের প্রশ্রয় দেয়ার শামিল। বিশেষজ্ঞরা অবিলম্বে মোবাইল ফোন অপারেটর রবির বিরুদ্ধে ৬৫০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ও অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার নামে শত কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি কঠোরভাবে তদন্ত করার দাবি জানান।
দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংসদ সদস্য এ কেএম মাইদুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে খোদ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকি সংসদকে জানিয়েছিলেন, ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত রবি আজিয়াটা লিমিটেডের কাছে সরকারের পাওনা ২১৯ দশমিক ১০ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ের মধ্যে অপারেটরটি বিদেশে পাঠিয়েছে ১২ দশমিক ২৯ কোটি টাকা। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই সময়ে একমাত্র টেলিটক ছাড়া অন্য পাঁচটি মোবাইল অপারেটর দুই হাজার ৫৪৭ দশমিক ১৪ কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে।
জানা গেছে, ১৫ বছর আগে মোবাইল ফোন অপারেটর একটেল পরবর্তীতে রবি আজিয়াটা নামে তাদের ব্যবসা শুরু করে। অভিযোগ, শুরুতে রবি ১৭ দশমিক ৮ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি (তরঙ্গ) নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও কোনো তরঙ্গ চার্জ দেয়নি। ওই সময় নানাভাবে তৎকালীন একটেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি ফি চাওয়া হলেও নীতিমালা না থাকার অজুহাতে রবিসহ কোনো অপারেটরই তরঙ্গ চার্জ দেয়নি।
বিটিআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যানে মেজর জেনারেল জিয়া আহম্মেদ পরবর্তীতে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেলে চাপের মুখে ২০০৮ সালে মাত্র ৫ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি ক্রয় করে রবি। বিটিআরসির অভিযোগ এর আগে ১১ বছর রবি সর্বনিু ১ হাজার কোটি টাকার এই প্রাকৃতিক সম্পদ বিনা পয়সায় ব্যবহার করেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ ধরনের কোনো আইন না থাকার সুযোগ নিয়ে রবি ওই সময় বিনা পয়সায় তরঙ্গ ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করলেও সরকারকে এজন্য কোনো ফি দেয়নি। ১ টাকার কল মিনিট বিক্রি করেছে ৭-৮ টাকায়। অথচ সে আমলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল এই ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করে। দেখা গেছে ভারত ওই সময় প্রতি মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করে আয় করছিল ১১৩ মিলিয়ন রুপি অথচ বাংলাদেশ হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা লাভকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এই তরঙ্গ দিয়েছিল স্রেফ শূন্য টাকায়। ২০০৮ সালে বিটিআরসি ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধেও রবি শুরুতে নানা টালবাহানা শুরু করে। এক পর্যায়ে সরকারের চাপের মুখে মাত্র ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ক্রয় করে রবি। অন্যান্য অপারেটরও টাকা দিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি ক্রয় করে। ফলশ্র“তিতে সরকার ৩ বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা আয় করে। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী তারপরও রবিসহ অন্যান্য অপারেটরের নামে অবিক্রীত ফ্রিকোয়েন্সি থেকে যায় ৬৫ মেগাহার্টজ। যা বিক্রি করা সম্ভব হলে সরকারের কোষাগারে আসত আরও ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের দূরদর্শিতা, অদক্ষতা এবং বিভিন্ন মহলের চাপের কারণে এ টাকা আয় করা সম্ভব হয়নি। অবিক্রীত ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে রবির কাছে ছিল ১২.৬ মেগাহার্টজ। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী এর দাম ছিল ১ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে রবি আজিয়াটার বিরুদ্ধে ৬৪৭ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ সংক্রান্ত ফাইলটি এখনও রহস্যজনক কারণে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
এদিকে তদন্ত রিপোর্টে ৬৪৭ কোটি টাকার কর ফাঁকির বিষয়টি স্পষ্ট করলেও রবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুপুন বীরাসিংহে ১৪ জুন এক লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ দাবি অনৈতিক এবং ভিত্তিহীন। তারপরও রবিসহ অন্যান্য মোবাইল অপারেটর সমঝোতার ভিত্তিতে সিম রিপ্লেসমেন্ট সংক্রান্ত অমূলক দাবি নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আরেক দিকে তিনি আবার বলেছেন, বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন আছে। সিম রিপ্লেসমেন্ট ইস্যুটি সম্পূর্ণভাবে মোবাইল ফোন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে শুধু রবিকে ঘিরে প্রতিবেদন অসৎ স্বার্থ চরিতার্থ করার একটি অপকৌশল।
সুপুন বীরাসিংহে আরও বলেছেন, রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও এর মূল কোম্পানি আজিয়াটা গ্র“প বারহাদ যা মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত একটি বিনিয়োগ। কোম্পানিটি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করে। একইভাবে সিম বদল বা পরিবর্তনে রবি বিটিআরসির নিদের্শিত বিধিমালা অনুসরণ করে থাকে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের জুন মাসে এনবিআর সিম রিপ্লেসমেন্ট বিষয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। বিশেষ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু রবিই ৬৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল দলিলাদি যাচাইয়ের মাধ্যমে সিম রিপ্লেসমেন্টের আগে ও পরে মালিকানা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে রবি এ অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য।
সিম রিপ্লেসমেন্ট তদন্তসংক্রান্ত বিশেষ কমিটি বিটিআরসির কারিগরি সহায়তায় প্রায় পাঁচ হাজার সিম নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেন। এর মধ্যে রবির ১ হাজার ২০০সহ বাকি ৩টি অপারেটরের ৩৬৯৭টি সিম রয়েছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে এ পরীক্ষায় রবির প্রায় ৯৫ শতাংশ সিমের ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, সেলফোন অপারেটররা সিম বদলের আড়ালে নতুন কার্ড ইস্যুর বিপরীতে বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক ও মূসক ফাঁকি দিচ্ছে।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, রবির রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ ৬৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ২০১১-এর জুন পর্যন্ত ৫২ লাখ ৬১ হাজার ৫৪১টি সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন গ্রাহকের কাছে সিম বিক্রি করে এ অর্থ ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে এনবিআর দাবি করছে।
এদিকে অবৈধ ভিওআইপি প্রসঙ্গে রবির সিইও সুপুন বীরাসিংহে জানান, কল সেন্টার প্রভাইডার জেনেক্স ইনফোসিসের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি করার অভিযোগ সঠিক নয়। একইভাবে বিটিআরসির সঙ্গে আঁতাত করে সিস ডিটেকশন বক্স রবির অফিসে স্থাপন করে ভিওআইপি করার অভিযোগটিও মিথ্যা। লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুযায়ী রবির অফিসেই সিম ডিটেকশন বক্স স্থাপন করা হয়েছে। সেদিক থেকে রবিই একমাত্র কোম্পানি যারা এই নির্দেশ পালন করেছে। তাছাড়া বিটিআরসি রবির সিস্টেমের সঙ্গে সরাসরি অনলাইন লিংক স্থাপনের মাধ্যমে কল আদান-প্রদানের তথ্য যাচাই করে থাকে। কাজেই অবৈধ ভিওআইপি করার কোনো সুযোগ নেই।
  
আপডেট : ০৬-১৭-২০১৪

0 comments:

Post a Comment